দুঃশাসনের রক্ত-পান কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম | কবিতার জগৎ

 বল রে বন্য হিংস্র বীর,  

 দুঃশাসনের চাই রুধির।  

 চাই রুধির রক্ত চাই,  

 ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই  

 দুঃশাসনের রক্ত চাই!  

 দুঃশাসনের রক্ত চাই!!   

  

 অত্যাচারী সে দুঃশাসন  

 চাই খুন তার চাই শাসন,  

 হাঁটু গেড়ে তার বুকে বসি  

 ঘাড় ভেঙে তার খুন শোষি।  

 আয় ভীম আয় হিংস্র বীর,  

 কর অ-কণ্ঠ পান রুধির।  

 ওরে এ যে সেই দুঃশাসন  

 দিল শত বীরে নির্বাসন,  

 কচি শিশু বেঁধে বেত্রাঘাত  

 করেছে রে এই ক্রূর স্যাঙাত।  

 মা-বোনেদের হরেছে লাজ  

 দিনের আলোকে এই পিশাচ।  

 বুক ফেটে চোখে জল আসে,  

 তারে ক্ষমা করা? ভীরুতা সে!  

 হিংসাশী মোরা মাংসাশী,  

 ভণ্ডামি ভালবাসাবাসি!  

 শত্রুরে পেলে নিকটে ভাই  

 কাঁচা কলিজাটা চিবিয়ে খাই!  

 মারি লাথি তার মড়া মুখে,  

 তাতা-থৈ নাচি ভীম সুখে।   

  

 নহি মোরা ভীরু সংসারী,  

 বাঁধি না আমরা ঘরবাড়ি।  

 দিয়াছি তোদের ঘরের সুখ,  

 আঘাতের তরে মোদের বুক।  

 যাহাদের তরে মোরা চাঁড়াল  

 তাহারাই আজি পাড়িছে গা’ল!  

 তাহাদের তরে সন্ধ্যা-দীপ.  

 আমাদের আন্দামান-দ্বীপ!  

 তাহাদের তরে প্রিয়ার বুক  

 আমাদের তরে ভীম চাবুক।  

 তাহাদের ভালবাসাবাসি,  

 আমাদের তরে নীল ফাঁসি।  

 বরিছে তাদের বাজিয়া শাঁখ,  

 মোদের মরণে নিনাদে ঢাক।   

  

 জীবনের ভোগ শুধু ওদের,  

 তরুণ বয়সে মরা মোদের।  

 কার তরে ওরে কার তরে  

 সৈনিক মোরা পচি মরে?  

 কার তরে পশু সেজেছি আজ,  

 অকাতরে বুক পেতে নি বাজ।  

 ধর্মাধর্ম কেন যে নাই  

 আমাদের, তাহা কে বোঝে ভাই?  

 কেন বিদ্রোহী সব-কিছুর?  

 সব মায়া কেন করেছি দূর?  

 কারে ক’স মন সে-ব্যথা তোর?  

 যার তরে চুরি বলে চোর।  

 যার তরে মাখি গায়ে কাদা,  

 সেই হয় এসে পথে বাধা।   

  

 ভয় নাই গৃহী! কোরো না ভয়,  

 সুখ আমাদের লক্ষ্য নয়।  

 বিরূপাক্ষ যে মোরা ধাতার,  

 আমাদের তরে ক্লেশ-পাথার।  

 কাড়ি না তোদের অন্ন-গ্রাস,  

 তোমাদের ঘরে হানি না ত্রাস;  

 জালিমের মোরা ফেলাই লাশ,  

 রাজ-রাজড়ার সর্বনাশ!  

 ধর্ম-চিন্তা মোদের নয়,  

 আমাদের নাই মৃত্যু-ভয়!  

 মৃত্যুকে ভয় করে যারা,  

 ধর্মধ্বজ হোক তারা।  

 শুধু মানবের শুভ লাগি  

 সৈনিক যত দুখভাগী।  

 ধার্মিক! দোষ নিয়ো না তার,  

 কোরবানির১ সে, নয় রোজার২ !  

 তোমাদের তরে মুক্ত দেশ,  

 মোদের প্রাপ্য তোদের শ্লেষ।   

  

 জানি জানি ঐ রণাঙ্গন  

 হবে যবে মোর মৃৎ-কাফন৩  

 ফেলিবে কি ছোট একটি শ্বাস?  

 তিক্ত হবে কি মুখের গ্রাস?  

 কিছুকাল পরে হাড্‌ডি মোর  

 পিষে যাবি ভাই জুতিতে তোর!  

 এই যারা আজ ধর্মহীন  

 চিনে শুধু খুন আর সঙিন;  

 তাহাদের মনে পড়িবে কার  

 ঘরে পড়ে যারা খেয়েছে মার?  

 ঘরে বসে নিস স্বর্গ-লোক,  

 মেরে মরে তারে দিস দোজখ৪!  

 ভয়ে-ভীরু ওরে ধর্মবীর!  

 আমরা হিংস্র চাই রুধির!  

 শহতান মোরা? আচ্ছা, তাই।  

 আমাদের পথে এসো না ভাই।   

  

 মোদের রক্ত-রুধির-রথ,  

 মোদের জাহান্নামের পথ,  

 ছেড়ে দেও ভাই জ্ঞান-প্রবীণ,  

 আমরা কাফের ধর্মহীন!  

 এর চেয়ে বেশি কি দেবে গা’ল?  

 আমরা পিশাচ খুন-মাতাল।  

 চালাও তোমার ধর্ম-রথ,  

 মোদের কাঁটার রক্ত-পথ।  

 আমরা বলিব সর্বদাই  

 দুঃশাসনের রক্ত চাই!!   

  

 চাই না ধর্ম, চাই না কাম,  

 চাই না মোক্ষ, সব হারাম  

 আমাদের কাছে: শুধু হালাল৫  

 দুশমন-খুন লাল-সে-লাল॥   

  

 ১ কোরবানি– বলি।  

 ২. রোজা– উপবাস  

 ৩. মৃৎ-কাফন –লাশ যেখানে থাকে।  

 ৪. দোজখ –নরক  

 ৫. হালাল –পবিত্র 

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাড়ি কবিতা - জসীম উদ্দীন | কবিতার জগৎ