বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম | কবিতার জগৎ

 বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী !  

 ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হ’য়ে এল বিদায়ের রাতি !  

 আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,  

 আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি --   

  

 অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ-কপোল রাখি’  

 কাঁদিতেছে চাঁদ, “মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকী |  

 নিশীথিনী যার দূর বন-ছায় তন্দ্রায় ঢুলু ঢুল্ ,  

 ফিরে ফিরে চায়, দু’-হাতে জড়ায় আঁধারের এলোচুল !”   

  

 চমকিয়া জাগি, ললাটে আমার কাহার নিশাস লাগে ?  

 কে করে ব্যজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে ?  

 জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী  

 নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি !   

  

 তোমাদের আর আমার আঁখির পল্লব-কম্পনে  

 সারা রাত মোরা ক’য়েছি যে কথা, বন্ধু পড়িছে মনে !  

 জাগিয়া একাকী জ্বালা ক’রে আঁখি আসিত যখন জল,  

 তোমাদের পাতা মনে হ’তে যেন সুশীতল করতল !   

  

 আমার প্রিয়ার !-- তোমার শাখার পল্লব-মর্মর  

 মনে হ’ত যেন তারি কন্ঠের আবেদন সকাতর|  

 তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আঁখির কাজল-লেখা,  

 তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা|   

  

 তব ঝির্-ঝির্ মির্-মির্ যেন তারি কুন্ঠিত বাণী,  

 তোমার শাখায় ঝুলানো তারির সাড়ির আঁচল খানি !  

.---তোমার পাখার হাওয়া  

 তারি অঙ্গুলি-পরশের মত নিবিড় আদর ছাওয়া !   

  

 ভাবিতে ভাবিতে ঢুলিয়া প’ড়েছি ঘুমের শ্রান্ত কোলে,  

 ঘুমায়ে স্বপন দেখেছি,----তোমারি সুনীল ঝালর দোলে  

 তেমনি আমার শিথানের পাশে | দেখেছি স্বপনে , তুমি  

 গোপনে আসিয়া গিয়াছ আমার তপ্ত ললাট চুমি’ !   

  

 হয়ত স্বপনে বাড়ায়েছি হাত লইতে পরশখানি,  

 বাতায়নে ঠেকি’ ফিরিয়া এসেছে লইয়াছি লাজে টানি’ |  

 বন্ধু, এখন রুদ্ধ করিতে হইবে সে বাতায়ন !  

 ডাকে পথ, হাঁকে যাত্রীরা, “কর বিদায়ের আয়োজন !”   

  

 --আজি বিদায়ের আগে  

 আমারে জানাতে তোমারে জানিতে কত কি যে সাধ জাগে !  

 মর্মের বাণী শুনি তব, শুধু মুখের ভাষায় কেন  

 জানিতে চায় ও বুকের ভাষারে লোভাতুর মন হেন !  

 জানি-----মুখে মুখে হবে না মোদের কোনোদিন জানাজানি,  

 বুকে বুকে শুধু বাজাইবে বীণা বেদনার বীণাপানি !   

 হয়ত তোমারে দেখিয়াছি, তুমি যাহা নও তাই ক’রে,  

 ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে ?  

 সুন্দর যদি করে গো তোমারে আমার আঁখির জল,  

 হারা-মোমতাজে ল’য়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজ-ম’ল,  

 --বল তাহে কার ক্ষতি ?  

 তোমাকরে লইয়া সাজাব না ঘর , সৃজিব অমরাবতী !--------   

  

 হয়ত তোমার শাখায় কখনো বসেনি আসিয়া শাখী,  

 তোমার কুঞ্জে পত্রকুঞ্জে কোকিল ওঠেনি ডাকি’ |  

 শূন্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া পল্লব-আবেদন  

 জেগেছে নিশীথে জাগে নি ক’ সাথে খুলি’ কেহ বাতায়ন |  

 --সব আগে আমি আসি’  

 তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ, গিয়াছে গো ভালবাসি’ !  

 তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা  

 এইটুকু হোক্ সান্ত্বনা মোর, হোক্ বা না হোক্ দেখা |-------   

  

 তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,  

 কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না |  

 -- নিশ্চল নিশ্চুপ  

 আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ !------   

  

 শুধাইতে নাই, তবুও শুধাই আজিকে যাবার আগে-----  

 ঐ পল্লব-জাফ্ রি খুলিয়া তুমিও কি অনুরাগে  

 দেখেছ আমারে ----দেখিয়াছি যবে আমি বাতায়ন খুলি’ ?  

 হাওয়ায় না মোর অনুরাগে তব পাতা উঠিয়াছে দুলি’ ?   

  

 তোমার পাতার হরিৎ আঁচলে চাঁদিনী ঘুমাবে যবে,  

 মূর্চ্ছিতা হবে সুখের আবেশ,----সে আলোর উত্সবে,  

 মনে কি পড়িবে এই ক্ষণিকের অতিথির কথা আর ?  

 তোমার নিশাস শূন্য এ ঘরে করিবে কি হাহাকার ?  

 চাঁদের আলোক বিস্বাদ কি গো লাগিবে সেদিন চোখে ?  

 খড়খড়ি খুলি’ চেয়ে রবে দূর অস্ত অলখ-লোকে ?  

 --অথবা এমনি করি’  

 দাঁড়ায়ে রহিবে আপন ধেয়ানে সারা দিনমান ভরি’ ?   

  

 মলিন মাটীর বন্ধনে বাঁধা হায় অসহায় তরু,  

 পদতলে ধূলি, ঊর্ধ্বে তোমার শূন্য গগন-মরু |  

 দিবসে পুড়িছ রৌদ্রের দাহে, নিশীথে ভিজিছ হিমে,  

 কাঁদিবারও নাই শকতি, মৃত্যু-আফিমে পড়িছ ঝিমে !  

 তোমার দুঃখ তোমারেই যদি, বন্ধু ব্যথা না হানে,  

 কি হবে রিক্ত চিত্ত ভরিয়া আমার ব্যথার দানে !   

  

 ভুল ক’রে কভু আসিলে স্মরণে অমনি তা যেয়ো ভুলি’  

 যদি ভুল ক’রে কখনো এ মোর বাতায়ন যায় খুলি’,  

 বন্ধ করিয়া দিও পুনঃ তায় !--- তোমার জাফ্ রি-ফাঁকে  

 খুঁজো না তাহারে গগন-আঁধারে----মাটিতে পেলে না যাকে !

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাড়ি কবিতা - জসীম উদ্দীন | কবিতার জগৎ