বঙ্গ-বন্ধু কবিতা - জসীম উদ্দীন || কবিতার জগৎ

 মুজিবর রহমান।  

 ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।  

 বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,  

 জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞঝা-অশনি বেয়ে ।  

 বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার।  

 হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যে অঙ্গার ;  

 দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,  

 দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে ;  

 তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি  

 ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।   

  

 মুজিবর রহমান।  

 তব অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত-স্নান।  

 পীড়িত-জনের নিশ্বাস তারে দিয়েছে চলার গতি,  

 বুলেটে নিহত শহীদেরা তার অঙ্গে দিয়েছে জ্যেতি।  

 দুর্ভিক্ষের দানব তাহারে অদম্য বল,  

 জঠরে জঠরে অনাহার-জ্বালা করে তারে চঞ্চল।  

 শত ক্ষতে লেখা অমর কাব্য হাসপাতালের ঘরে,  

 মুর্হুমুহু যে ধবনিত হইছে তোমার পথের পরে।  

 মায়ের বুকের ভায়ের বুকের বোনের বুকের জ্বালা,  

 তব সম্মুখ পথে পথে আজ দেখায়ে চলিছে আলা।  

 জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী পাছে,  

 তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।  

 রাজভয় আর কারাশৃঙ্কল হেলায় করেছ জয়।  

 ফাঁসির মঞ্চে-মহত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়।  

 বাঙলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমুর্ত রাজ,  

 প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।  

 তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার।  

 অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছে-স্তব্ধ হুকুমদার।   

  

 এই বাঙলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ,  

 সন্ন্যাসী বেশে দেশ-বন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক।  

 শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী-জীবন করিয়া দান,  

 মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।  

 তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর,  

 জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাঙলার।   

  

 সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,  

 কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস।  

 তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়,  

 আমরা বাঙালীর মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।   

  

 ধন্য এ কবি ধন্য এ যুগে রয়েছে জীবন লয়ে,  

 সম্মুখে তার মহাগৌরবে ইতিহাস চলে বয়ে।  

 ভুলিব না সেই মহিমার দিন, ভাষার আন্দোলনে ।  

 বুরেটের ভয় তুচ্ছ করিয়া ছেলেরা দাঁড়াল রণে ।  

 বরকত আর জব্বার আর সালাম পথের মাঝে,  

 পড়ে বলে গেলো, “আমরা চলিনু ভাইরা আসিও পাছে।”  

 উত্তর তার দিয়েছে বাঙালী, জানুয়ারী সত্তরে,  

 ঘরের বাহির হইল ছেলেরা বুলেটের মহা-ঝড়ে।  

 পথে পথে তারা লিখিল লেখন বুকের রক্ত দিয়ে,  

 লক্ষ লক্ষ ছুটিল বাঙালী সেই বাণী ফুকারিয়ে।  

 মরিবার সে কি উন্মাদনা যে, ভয় পালাইল ভয়ে,  

 পাগলের মত ছোট নর-নারী মৃত্যুরে হাতে লয়ে।  

 আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,  

 দিকে দিগনে- বাজিল যেদিন বাঙালীর জয়ভেরী।  

 মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার,  

 বঙ্গ-বঙ্গ শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।  

 আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা,  

 জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা।  

 মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,  

 বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকসী-কাঁথার ছবি।  

 মানুষ মানুষ রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার,  

 এক সাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার।  

 পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর রুপালীর তার পরে,  

 পরাণ ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্বভরে।  

 আম-কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কুটিরগুলির তলে,  

 সুখ যে আসিয়া গড়াগড়ি করি খেলাইবে কুতুহলে।   

  

 আরো একদিন ধন্য হইব চির-নির্ভীকভাবে,  

 আমাদরে জাতি নেতার পাগড়ি ধরিয়া জবাব চাবে,  

 “কোন অধিকারে জাতির স্বার্থ করিয়াছ বিক্রয়?”  

 আমার এদেশ হয় যেন সদা সেইরুপ নির্ভয়। 

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাড়ি কবিতা - জসীম উদ্দীন | কবিতার জগৎ