সব্যসাচী কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম | kobitar jagot

 ওরে ভয় নাই আর, দুলিয়া উঠেছে হিমালয়-চাপা প্রাচী,  

 গৌরশিখরে তুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী!  

 দ্বাপর যুগের মৃত্যু ঠেলিয়া  

 জাগে মহাযোগী নয়ন মেলিয়া,  

 মহাভারতের মহাবীর জাগে, বলে ‘আমি আসিয়াছি।’  

 নব-যৌবন-জলতরঙ্গে নাচে রে প্রাচীন প্রাচী!   

  

 বিরাট কালের অজ্ঞাতবাস ভেদিয়া পার্থ জাগে,  

 গান্ডীব ধনু রাঙিয়া উঠিল লক্ষ লাক্ষারাগে!  

 বাজিছে বিষাণ পাঞ্চজন্য,  

 সাথে রথাশ্ব, হাঁকিছে সৈন্য,  

 ঝড়ের ফুঁ দিয়া নাচে অরণ্য, রসাতলে দোলা লাগে,  

 দোলায় বসিয়া হাসিছে জীবন মৃত্যুর অনুরাগে!   

  

 যুগে যুগে ম’রে বাঁচে পুনঃ পাপ দুর্মতি কুরুসেনা,  

 দুর্যোধনের পদলেহী ওরা, দুঃশাসনের কেনা!  

 লঙ্কাকান্ডে কুরুক্ষেত্রে,  

 লোভ-দানবের ক্ষুধিত নেত্রে,  

 ফাঁসির মঞ্চে কারার বেত্রে ইহারা যে চির-চেনা!  

 ভাবিয়াছ, কেহ শুধিবে না এই উৎপীড়নের দেনা?   

  

 কালের চক্র বক্রগতিতে ঘুরিতেছে অবিরত,  

 আজ দেখি যারা কালের শীর্ষে, কাল তারা পদানত।  

 আজি সম্রাট্‌ কালি সে বন্দী,  

 কুটীরে রাজার প্রতিদ্বন্দী!  

 কংস-কারায় কংস-হন্তা জন্মিছে অনাগত,  

 তারি বুক ফেটে আসে নৃসিংহ যারে করে পদাহত!   

  

 আজ যার শিরে হানিছে পাদুকা কাল তারে বলে পিতা,  

 চির-বন্দিনী হতেছে সহসা দেশ-দেশ-নন্দিতা।  

 দিকে দিকে ঐ বাজিছে ডঙ্কা,  

 জাগে শঙ্কর বিগত-শঙ্কা!  

 লঙ্কা সায়রে কাঁদে বন্দিনী ভারত-লক্ষ্মী সীতা,  

 জ্বলিবে তাঁহারি আঁখির সুমুখে কাল রাবণের চিতা!   

  

 যুগে যুগে সে যে নব নব রূপে আসে মহাসেনাপতি,  

 যুগে যুগে হ’ন শ্রীভগবান্‌ যে তাঁহারই রথ-সারথি!  

 যুগে যুগে আসে গীতা-উদ্‌গাতা  

 ন্যায়-পান্ডব-সৈন্যের ত্রাতা।  

 অশিব-দক্ষযজ্ঞে যখনই মরে স্বাধীনতা-সতী,  

 শিবের খড়গে তখনই মুন্ড হারায়েছে প্রজাপতি!   

  

 নবীন মন্ত্রে দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী,  

 জাগো রে জোয়ান! ঘুমায়ো না ভূয়ো শান্তির বাণী শুনি-  

 অনেক দধীচি হাড় দিল ভাই,  

 দানব দৈত্য তবু মরে নাই,  

 সুতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, ব’সে ব’সে কাল গুণি!  

 জাগো রে জোয়ান! বাত ধ’রে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি!   

 দক্ষিণ করে ছিঁড়িয়া শিকল, বাম করে বাণ হানি’  

 এস নিরস্ত্র বন্দীর দেশে হে যুগ-শস্ত্রপাণি!  

 পূজা ক’রে শুধু পেয়েছি কদলী,  

 এইবার তুমি এস মহাবলী।  

 রথের সুমুখে বসায়ো চক্রী চত্রুধারীরে টানি’,  

 আর সত্য সেবিয়া দেখিতে পারি না সত্যের প্রাণহানি।   

  

 মশা মেরে ঐ গরজে কামান-‘বিপ্লব মারিয়াছি।  

 আমাদের ডান হাতে হাতকড়া, বাম হাতে মারি মাছি!’  

 মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি,  

 টিকি দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি!  

 বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী,  

 যা হোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার ম’রে বাঁচি! 

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাড়ি কবিতা - জসীম উদ্দীন | কবিতার জগৎ