পুরস্কার কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে  

 কহিল কবির স্ত্রী  

 'রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,  

 রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,  

 মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,  

 তার খোঁজ রাখ কি!  

 গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব---  

 মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম,  

 মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,  

 না মিলে শস্যকণা।  

 অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,  

 নিশিদিন ধ'রে এ কি ছেলেখেলা!  

 ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা  

 লক্ষ্মীর উপাসনা।  

 ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী,  

 যা করিতে হয় করহ এখনি।  

 এত শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি  

 কিসে কড়ি আসে দুটো!'  

 দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া  

 কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া,  

 পরিহাসছলে ঈষত্ হাসিয়া  

 কহে জুড়ি করপুট,  

 'ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে,  

 লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে,  

 ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে  

 এ কথা শুনিবে কেবা!  

 আমার কপালে বিপরীত ফল---  

 চপলা লক্ষ্মী মোর অচপল,  

 ভারতী না থাকে থির এক পল  

 এতো করি তাঁর সেবা।  

 তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল  

 স্বর্গে মর্তে খুঁজিতেছি মিল,  

 আনমনা যদি হই এক-তিল  

 অমনি সর্বনাশ!'  

 মনে মনে হাসি মুখ করি ভার  

 কহে কবিজায়া, 'পারি নেকো আর,  

 ঘরসংসার গেল ছারেখার,  

 সব তাতে পরিহাস!'  

 এতেক বলিয়া বাঁকায়ে মুখানি  

 শিঞ্জিত করি কাঁকন-দুখানি  

 চঞ্চল করে অঞ্চল টানি  

 রোষছলে যায় চলি।  

 হেরি সে ভুবন-গরব-দমন  

 অভিমানবেগে অধীর গমন  

 উচাটন কবি কহিল, 'অমন  

 যেয়ো না হৃদয় দলি।  

 ধরা নাহি দিলে ধরিব দু পায়,  

 কী করিতে হবে বলো সে উপায়,  

 ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায়---  

 বুদ্ধি জোগাও তুমি।  

 একটুকু ফাঁকা যেখানে যা পাই  

 তোমার মুরতি সেখানে চাপাই,  

 বুদ্ধির চাষ কোনোখানে নাই---  

 সমস্ত মরুভূমি।'  

 'হয়েছে, হয়েছে, এত ভালো নয়'  

 হাসিয়া রুষিয়া গৃহিণী ভনয়,  

 'যেমন বিনয় তেমনি প্রণয়  

 আমার কপালগুণে।  

 কথার কখনো ঘটে নি অভাব,  

 যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব,  

 একবার ওগো বাক্য-নবাব  

 চলো দেখি কথা শুনে।  

 শুভ দিন ক্ষন দেখো পাঁজি খুলি,  

 সঙ্গে করিয়া লহো পুঁথিগুলি,  

 ক্ষনিকের তরে আলস্য ভুলি  

 চলো রাজসভা-মাঝে।  

 আমাদের রাজা গুণীর পালক,  

 মানুষ হইয়া গেল কত লোক,  

 ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক  

 লাগিবে কিসের কাজে!'  

 কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ,  

 ভাবিল--- বিপদ দেখিতেছি আজ,  

 কখনো জানি নে রাজা মহারাজ,  

 কপালে কী জানি আছে!  

 মুখে হেসে বলে, 'এই বৈ নয়!  

 আমি বলি, আরো কী করিতে হয়!  

 প্রাণ দিতে পারি, শুধু জাগে ভয়  

 বিধবা হইবে পাছে।  

 যেতে যদি হয় দেরিতে কী কাজ,  

 ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ---  

 হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ,  

 কেয়ূর, কনকহার।  

 বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে  

 ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে,  

 কিঙ্করগণ সাথে যাবে কে কে  

 আয়োজন করো তার।'  

 ব্রাহ্মণী কহে, 'মুখাগ্রে যার  

 বাধে না কিছুই, কী চাহে সে আর  

 মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার  

 না দেখি আবশ্যক।  

 নানা বেশভূষা হীরা রুপা সোনা  

 এনেছি পাড়ার করি উপাসনা,  

 সাজ করে লও পুরায়ে বাসনা,  

 রসনা ক্ষান্ত হোক।'  

 এতেক বলিয়া ত্বরিতচরণ  

 আনে বেশবাস নানান-ধরন,  

 কবি ভাবে মুখ করি বিবরন---  

 আজিকে গতিক মন্দ।  

 গৃহিণী স্বয়ং নিকটে বসিয়া  

 তুলিল তাহারে মাজিয়া ঘষিয়া,  

 আপনার হাতে যতনে কষিয়া  

 পরাইল কটিবন্ধ।  

 উষ্ণীষ আনি মাথায় চড়ায়,  

 কণ্ঠী আনিয়া কণ্ঠে জড়ায়,  

 অঙ্গদ দুটি বাহুতে পরায়,  

 কুণ্ডল দেয় কানে।  

 অঙ্গে যতই চাপায় রতন  

 কবি বসি থাকে ছবির মতন,  

 প্রেয়সীর নিজ হাতের যতন  

 সেও আজি হার মানে।  

 এইমতে দুই প্রহর ধরিয়া  

 বেশভূষা সব সমাধা করিয়া  

 গৃহিণী নিরখে ঈষত সরিয়া  

 বাঁকায়ে মধুর গ্রীবা।  

 হেরিয়া কবির গম্ভীর মুখ  

 হৃদয়ে উপজে মহা কৌতুক;  

 হাসি উঠি কহে ধরিয়া চিবূক,  

 'আ মরি, সেজেছ কিবা!'  

 ধরিল সমুখে আরশি আনিয়া;  

 কহিল বচন অমিয় ছানিয়া,  

 'পুরনারীদের পরান হানিয়া  

 ফিরিয়া আসিবে আজি।  

 তখন দাসীরে ভুলো না গরবে,  

 এই উপকার মনে রেখো তবে,  

 মোরেও এমন পরাইতে হবে  

 রতনভূষণরাজি।'  

 কোলের উপরে বসি বাহুপাশে  

 বাঁধিয়া কবিরে সোহাগে সহাসে  

 কপোল রাখিয়া কপোলের পাশে  

 কানে কানে কথা কয়। 


*সংক্ষিপ্ত* 

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাড়ি কবিতা - জসীম উদ্দীন | কবিতার জগৎ