Posts

অপমান বর কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে।    কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে।    কেহ কহে মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো',    সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ।    কেহ বলে তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে',    কেহ কয় ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে'।       কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে,    দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে--    ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব,    সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব।    একি কৌশল খেলেছ মায়াবী, বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি।    বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে নাকি!'       ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি--    লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি!    চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা,    এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা।    ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে--    গোপনে তাহারে মন্ত্রণ...

অন্তর্যামী কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | bangla kobita

 এ কী কৌতুক নিত্যনূতন    ওগো কৌতুকময়ী,    আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে    বলিতে দিতেছ কই।    অন্তরমাঝে বসি অহরহ    মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,    মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ    মিশায়ে আপন সুরে।    কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,    তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,    সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই,    কোথা ভেসে যাই দূরে।    বলিতেছিলাম বসি এক ধারে    আপনার কথা আপন জনারে,    শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে    ঘরের কাহিনী যত--    তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে    ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে    নবীন প্রতিমা নব কৌশলে    গড়িলে মনের মতো।       সে মায়ামুরতি কী কহিছে বাণী,    কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি--    আমি চেয়ে আছি বিস্ময়ে মানি    রহস্যে নিমগন।    এ যে সংগীত কোথা হতে উঠে,    এ যে লাবণ্য কোথা হতে ফুটে,    এ যে ক্রন্দন কোথা হতে টুটে    অন্তরব...

অন্তর মম বিকশিত করো - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতা

 অন্তর মম বিকশিত করো    অন্তরতর হে।    নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,    সুন্দর কর হে।    জাগ্রত করো, উদ্যত করো,    নির্ভয় করো হে।    মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।    অন্তর মম বিকশিত করো,    অন্তরতর হে।       যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,    মুক্ত করো হে বন্ধ,    সঞ্চার করো সকল মর্মে    শান্ত তোমার ছন্দ।    চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,    নন্দিত করো, নন্দিত করো,    নন্দিত করো হে।    অন্তর মম বিকশিত করো    অন্তরতর হে।

আচলা বুড়ি কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 অচলবুড়ি, মুখখানি তার হাসির রসে ভরা    স্নেহের রসে পরিপক্ক অতিমধুর জরা।    ফুলো ফুলো দুই চোখে তার, দুই গালে আর ঠোঁটে    উছলে-পড়া হৃদয় যেন ঢেউ খেলিয়ে ওঠে।    পরিপুষ্ট অঙ্গটি তার, হাতের গড়ন মোটা,    কপালে দুই ভুরুর মাঝে উল্কি-আঁকা ফোঁটা।    গাড়ি-চাপা কুকুর একটা মরতেছিল পথে,    সেবা ক'রে বাঁচিয়ে তারে তুলল কোনোমতে।    খোঁড়া কুকুর সেই ছিল তার নিত্যসহচর;    আধপাগলি ঝি ছিল এক, বাড়ি বালেশ্বর।    দাদাঠাকুর বলত, বুড়ি, জমল কত টাকা,    সঙ্গে ওটা যাবে না তো, বাক্সে রইল ঢাকা,    ব্রাহ্মণে দান করতে না চাও নাহয় দাও-না-ধার,    জানোই তো এই অসময়ে টাকার কী দরকার।    বুড়ি হেসে বলে, ঠাকুর, দরকার তো আছেই,    সেইজন্যে ধার না দিয়ে রাখি টাকা কাছেই।       সাঁৎরাপাড়ার কায়েতবাড়ির বিধবা এক মেয়ে,    এককালে সে সুখে ছিল বাপের আদর পেয়ে।    বাপ মরেছে, স্বামী গেছে, ভাইরা না দেয় ঠাঁই--    দিন চালাবে এম...

আচল স্মৃতি কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | বাংলা কবিতা

 আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে    জাগিয়া রয়েছে নিতি    অচল ধবল শৈল-সমান    একটি অচল স্মৃতি।    প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি    সে নীরব হিমগিরি    আমার দিবস আমার রজনী    আসিছে যেতেছে ফিরি।       যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর    মর্ম গভীরতম—    উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া    সকল উচ্চে মম।    মোর কল্পনা শত    রঙিন মেঘের মতো    তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে,    সোহাগে হতেছে নত।       আমার শ্যামল তরুলতাগুলি    ফুলপল্লবভারে    সরস কোমল বাহুবেষ্টনে    বাঁধিতে চাহিছে তারে।    শিখর গগনলীন    দুর্গম জনহীন,    বাসনাবিহগ একেলা সেথায়    ধাইছে রাত্রিদিন।       চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া,    কত গীত , কত কথা —    মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন    নিশ্চল নীরবতা।    দূরে গেলে তবু, একা    সে শিখর যায় দেখা — ...

অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুম | বাংলা কবিতা

 অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ    আকস্মিক চেতনার নিবিড়তায়    চঞ্চল হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,    তখন কোন্ কথা জানাতে তার এত অধৈর্য।    --যে কথা দেহের অতীত।    খাঁচার পাখির কণ্ঠে যে বাণী    সে তো কেবল খাঁচারি নয়,    তার মধ্যে গোপনে আছে সুদূর অগোচরের অরণ্য-মর্মর,    আছে করুণ বিস্মৃতি।    সামনে তাকিয়ে চোখের দেখা দেখি--    এ তো কেবলি দেখার জাল-বোনা নয়।--    বসুন্ধরা তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষে    দেশ-পারানো কোন্ দেশের দিকে,    দিগ্বলয়ের ইঙ্গিতলীন    কোন্ কল্পলোকের অদৃশ্য সংকেতে।    দীর্ঘপথ ভালোমন্দয় বিকীর্ণ,    রাত্রিদিনের যাত্রা দুঃখসুখের বন্ধুর পথে।    শুধু কেবল পথ চলাতেই কি এ পথের লক্ষ্য?    ভিড়ের কলরব পেরিয়ে আসছে গানের আহ্বান,    তার সত্য মিলবে কোন্খানে?    মাটির তলায় সুপ্ত আছে বীজ।    তাকে স্পর্শ করে চৈত্রের তাপ,    মাঘের হিম, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা।   ...

অক্ষমা কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | বাংলা কবিতা

 যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার,    দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।    জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার    বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।    অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে,    হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী।    সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে,    পারিস নে কত বার — 'কই অন্ন কই '    কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ।    জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ—    যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় ,    সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক ,    সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়—    তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক!

অক্ষমতা কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | বাংলা কবিতা

 এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা —    সলিল রয়েছে প'ড়ে, শুধু দেহ নাই।    এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা    সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই - চাই।    দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল    কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!    মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল —    বিশ্ব যেন চিত্রপট, আমি যেন আঁকা!    চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন    আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে,    মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন    আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে।    কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!    কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময়! 

হিং টিং ছট কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ-    অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ।    শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাদঁরে    উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে-    একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড়,    চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড়।    সহসা মিলালো তারা, এল এক বেদে,    ‘পাখি উড়ে গেছে ‘ব‘লে মরে কেঁদে কেঁদে।    সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে,    ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচু এক দাঁড়ে।    নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়থুড়ি    হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি।    রাজা বলে ‘কী আপদ ‘ কেহ নাহি ছাড়ে-    পা দুটা তুলিতে চাহে, তুলিতে না পারে।    পাখির মত রাজা করে ঝটপট্    বেদে কানে কানে বলে - হিং টিং ছট্।    স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,    গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।    হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয় –সাত    চোখে কারো নিদ্রা নাই, পেটে নাই ভাত।    শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির    রাজ্যসুদ্ধ বালকবৃদ্ধ ভেবেই অস্...

কাগজের নৌকা কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে    কাগজ-নৌকাখানি।    লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,    লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম    বড়ো বড়ো ক’রে মোটা অক্ষরে    যতনে লাইন টানি।    যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে    আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে    আমার লিখন পড়িয়া তখন    বুঝিবে সে অনুমানি    কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে    কাগজ-নৌকাখানি।।       আমার নৌকা সাজাই যতনে    শিউলি বকুলে ভরি।    বাড়ির বাগানে গাছের তলায়    ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,    শিশিরের জল করে ঝলমল    প্রভাতের আলো পড়ি।    সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা    কোন্ দিক-পানে চলে যায় সোজা,    বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী    ঠেকে কোনোখানে যেয়ে-    প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল    কাগজের তরী বেয়ে।।       আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে    চেয়ে থাকি বসি তীরে।    ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,   ...

যাবার দিন কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

  যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই –   যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।   এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে যে শতদল পদ্ম রাজে   তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই।   যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।    বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,   অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।   পরশ যাঁরে যায় না করা সকল দেহে দিলেন ধরা,   এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই –   যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।

বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা - কাজী নজরুল ইসলাম | kobitar jagot

 বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা  শির উঁচু করি মুসলমান।  দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার  ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।   মুখেতে কালেমা হাতে তলোয়ার,  বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার,  হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর  চল আগে চল বাজে বিষান।  ভয় নাই তর গলায় তাবিজ  বাঁধা যে রে তোর পাক কোরান।।   নহি মোরা জীব ভোগ- বিলাসের,  শাহাদাত ছিল কাম্য মোদের,  ভিখারির সাজে খলীফা যাদের  শাসন করিল আধা জাহান-  তারা আজ পড়ে ঘুমায়ে বেহুঁশ  বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান।।   ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,  তখনো জাগিনি যখন যোহর,  হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর  মাগরিবের আজ শুনি আজান।  জামাত শামিল হওরে এশাতে  এখনো জমাতে আছে স্থান।।   শুকনো রুটিকে সম্বল ক’রে  যে ঈমান আর যে প্রানের জোরে  ফিরেছে জগত মন্থন ক’রে  সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।  আল্লাহ আকবর রবে পুনঃ  কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান।