Posts

পুজার সাজ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,    পূজার সময় এল কাছে।    মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই    আনন্দে দু হাত তুলি নাচে।       পিতা বসি ছিল দ্বারে; দুজনে শুধালো তারে,    'কী পোশাক আনিয়াছ কিনে।'    পিতা কহে, 'আছে আছে তোদের মায়ের কাছে,    দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে।'       সবুর সহে না আর - জননীরে বার বার    কহে, 'মা গো, ধরি তোর পায়ে,    বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে    একবার দে-না, মা, দেখায়ে।'    ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি ছিটের জামা    দেখাইল করিয়া আদর ।    মধু কহে, 'আর নেই?' মা কহিল, 'আছে এই    একজোড়া ধুতি ও চাদর।'       রাগিয়া আগুন ছেলে - কাপড় ধুলায় ফেলে    কাঁদিয়া কহিল, 'চাহি না মা!    রায়বাবুদের গুপি পেয়েছে জরির টুপি    ফুলকাটা সাটিনের জামা।'    মা কহিল, 'মধু, ছি ছি, কেন কাঁদ মিছামিছি!    গরিব যে তোমাদের বাপ।    এবা...

পুরস্কার কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে    কহিল কবির স্ত্রী    'রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,    রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,    মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,    তার খোঁজ রাখ কি!    গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব---    মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম,    মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,    না মিলে শস্যকণা।    অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,    নিশিদিন ধ'রে এ কি ছেলেখেলা!    ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা    লক্ষ্মীর উপাসনা।    ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী,    যা করিতে হয় করহ এখনি।    এত শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি    কিসে কড়ি আসে দুটো!'    দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া    কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া,    পরিহাসছলে ঈষত্ হাসিয়া    কহে জুড়ি করপুট,    'ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে,    লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে,    ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে    এ কথা শুনিবে কেবা!    আমার কপালে বিপরীত ফল--- ...

ন্যায়দন্ড কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 তোমার ন্যায়ের দণ্ড প্রত্যেকের করে    অর্পণ করেছ নিজে। প্রত্যেকের ’পরে    দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ।    সে গুরু সম্মান তব সে দুরূহ কাজ    নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি    সবিনয়ে। তব কার্যে যেন নাহি ডরি    কভু কারে।       ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,    হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা    তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম    সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়্গসম    তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান    তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্হান।       অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে    তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।

নিদ্রিতা কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 একদা রাতে নবীন যৌবনে    স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,    বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার---    ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া ।    শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,    পূর্বতটে হতেছে নিশিভোর ।    আকাশকোণে বিকাশে জাগরণ,    ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর ।    সমুখে প'ড়ে দীর্ঘ রাজপথ,    দু ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,    নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে    আপন-মনে ভাবিনু একবার---    অরুণ-রাঙা আজি এ নিশিশেষে    ধরার মাঝে নূতন কোন্ দেশে    দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা    স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা ।।       অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,    কত যে দেশ বিদেশ হনু পার !    একদা এক ধূসরসন্ধ্যায়    ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার ।    সবাই সেথা অচল অচেতন,    কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী,    নদীর তীরে জলের কলতানে    ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি ।    ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,    নিমেষে পাছে সকল দেশ...

দুই বিঘা জমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।    বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।'    কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই -    চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।    শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,    পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা -    ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি    সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।    সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,    দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'    আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,    কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'       পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে -    করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।    এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,    রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।    মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,    ...

দায়মোচন কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,    এ কথা বলিতে চাও বোলো।    এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল -    তার পরে যদি তুমি ভোল    মনে করাব না আমি শপথ তোমার,    আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার -    যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,    আবার আসিতে হয় এসো।    সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,    তবু ভালোবাস যদি বেসো।।       বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,    পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।    অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি    যাত্রায় নাহি দিব বাধা।    আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,    ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী,    তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন    আমার স্মৃতির আঁখিজলে -    আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন    রবে তব বিস্মৃতিতলে।।       দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে    যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে,    হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে -    নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।    মার্জনা কর য...

ঝুলন কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitarjagot

 আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা    নিশীথবেলা।    সঘন বরষা, গগন আঁধার    হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার---    ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা;    বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা    রাত্রিবেলা॥       ওগো,পবনে গগনে সাগরে আজিকে কী কল্লোল!    দে দোল্ দোল্।    পশ্চাত্ হতে হাহা ক'রে হাসি    মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,    যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর অট্টরোল।    আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে হট্টগোল!    দে দোল্ দোল্।       আজি জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার বসিয়া আছে    বুকের কাছে।    থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,    ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া,    নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে হৃদয় নাচে;    ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার ব্যাকুলিয়াছে    বুকের কাছে॥       হায়, এতকাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে    শয়ন-'পরে।    ব্যথা পাছে লাগে---- দুখ পাছে জাগে    নিশিদি...

ঝড়ের দিনে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 আজি এই আকুল আশ্বিনে    মেঘে-ঢাকা দুরন্ত দুর্দিনে    হেমন্ত-ধানের খেতে বাতাস উঠেছে মেতে,    কেমনে চলিবে পথ চিনে?    আজি এই দুরন্ত দুর্দিনে!       দেখিছ না ওগো সাহসিকা,    ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা!    মনে ভেবে দেখো তবে এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে    কবরীর শেফালিমালিকা।    ভেবে দেখো ওগো সাহসিকা!       আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়    নূপুর বাঁধে কি কেহ পায়?    যদি আজি বৃষ্টির জল ধুয়ে দেয় নীলাঞ্চল    গ্রামপথে যাবে কি লজ্জায়    আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়?       হে উতলা শোনো কথা শোনো,    দুয়ার কি খোলা আছে কোনো?    এ বাঁকা পথের শেষে মাঠ যেথা মেঘে মেশে    বসে কেহ আছে কি এখনো?    এ দুর্যোগে, শোনো ওগো শোনো!       আজ যদি দীপ জ্বালে দ্বারে    নিবে কি যাবে না বারে বারে?    আজ যদি বাজে বাঁশি গান কি যাবে না ভাসি    আশ্বিনের অসীম আঁধারে    ঝড়ে...

ছল কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 তোমারে পাছে সহজে বুঝি  তাই কি এত লীলার ছল -    বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল।    বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা -    যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।।       তোমারে পাছে সহজে ধরি কিছুরই তব কিনারা নাই -    দশের দলে টানি গো পাছে কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।    বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা -    যে পথে তুমি চলিতে চাও সে পথে তুমি চল না।।       সবার চেয়ে অধিক চাহ, তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও -    হেলার ভরে খেলার মতো ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?    বুঝেছি আমি, বুজেছি তব ছলনা -    সবার যাহে তৃপ্তি হল তোমার তাহে হল না।

'ছয়' কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 অতিথিবৎসল,    ডেকে নাও পথের পথিককে    তোমার আপন ঘরে,    দাও ওর ভয় ভাঙিয়ে।    ও থাকে প্রদোষের বস্তিতে,    নিজের কালো ছায়া ওর সঙ্গে চলে    কখনো সমুখে কখনো পিছনে,    তাকেই সত্য ভেবে ওর যত দুঃখ যত ভয়।    দ্বারে দাঁড়িয়ে তোমার আলো তুলে ধরো,    ছায়া যাক মিলিয়ে,    থেমে যাক ওর বুকের কাঁপন।       বছরে বছরে ও গেছে চলে    তোমার আঙিনার সামনে দিয়ে,    সাহস পায় নি ভিতরে যেতে,    ভয় হয়েছে পাছে ওর বাইরের ধন    হারায় সেখানে।    দেখিয়ে দাও ওর আপন বিশ্ব    তোমার মন্দিরে,    সেখানে মুছে গেছে কাছের পরিচয়ের কালিমা,    ঘুচে গেছে নিত্যব্যবহারের জীর্ণতা,    তার চিরলাবণ্য হয়েছে পরিস্ফুট।       পান্থশালায় ছিল ওর বাসা,    বুকে আঁকড়ে ছিল তারই আসন, তারই শয্যা,    পলে পলে যার ভাড়া জুগিয়ে দিন কাটালো    কোন্ মুহূর্তে তাকে ছাড়বে ভয়ে ...

চির আমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,    বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,    চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা    বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -    আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,    তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।       যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,    কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,    ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,    শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -    আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,    তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।       যখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,    কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।    ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সেদিন উঠবে ভরি,    চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।    আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,    তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।       তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?    সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি। ...

চিত্ত তোমায় নিত্য হবে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে    সত্য হবে -    ওগো সত্য, আমার এখন সুদিন।    ঘটবে কবে।    সত্য সত্য সত্য জপি,    সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি,    সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব    নিখিল ভবে -    সত্য তোমার পূর্ণ প্রকাশ    দেখব কবে।       তোমায় দূরে সরিয়ে মরি    আপন অসত্যে।    কী যে কান্ড করি গো সেই    ভূতের রাজত্বে।    আমার আমি ধুয়ে মুছে    তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে,    সত্য, তোমায় সত্য হব    বাঁচব তবে -    তোমার মধ্যে মরণ আমার মরবে কবে।