সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ - কাজী নজরুল ইসলাম | কবিতার জগৎ

 হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি,  

 এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি!  

 এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান,  

 বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরলি না প্রাণ?  

 দুরন্ত গো, মহাবাহু  

 ওগো রাহু,  

 তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী!  

 সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী!   

  

 হে দুর্গম! খোলো খোলো খোলো দ্বার।  

 সারি সারি গিরি-দরী দাঁড়ায়ে দুয়ারে করে প্রতীক্ষা তোমার।  

 শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি  

 করিছে বন্দনা তব, বলী!  

 তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কল্লোল  

 আপনাতে আপনি বিভোল!  

 পাশে না শ্রবণে তব ধরণীতে শত দুঃখ-গীত;  

 দেখিতেছ বর্তমান, দেখেছ অতীত,  

 দেখিবে সুদূরে ভবিষ্যৎ-  

 মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রষ্টা, ঋষি, উদাসীনবৎ!  

 ওঠে ভাঙে তব বুকে তরঙ্গের মতো  

 জন্ম-মৃত্যু দুঃখ-সুখ, ভূমানন্দে হেরিছ সতত!   

  

 হে পবিত্র! আজিও সুন্দর ধরা, আজিও অম্লান  

 সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়া নিতি স্নান!  

 জগতের যত পাপ গ্লানি  

 হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তব স্নেহ-পাণি!  

 ধরা তব আদরিনী মেয়ে,  

 তাহারে দেখিতে তুমি আস’ মেঘ বেয়ে!  

 হেসে ওঠে তৃণে-শস্যে দুলালী তোমার,  

 কালো চোখ বেয়ে ঝরে হিম-কণা আনন্দাশ্রু-ভরা!  

 জলধারা হ’য়ে নামো, দাও কত রঙিন যৌতুক,  

 ভাঙ’ গড়’ দোলা দাও,-  

 কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক!  

 হে বিরাট, নাহি তব ক্ষয়,  

 নিত্য নব নব দানে ক্ষয়েরে ক’রেছ তুমি জয়!   

 হে সুন্দর! জলবাহু দিয়া  

 ধরণীর কটিতট আছো আঁকড়িয়া  

 ইন্দ্রানীলকান্তমণি মেখলার সম,  

 মেদিনীর নিতম্ব সাথে দোল’ অনুপম!  

 বন্ধু, তব অনন্ত যৌবন  

 তরঙ্গে ফেনায়ে ওঠে সুরার মতন!  

 কত মৎস্য-কুমারীরা নিত্য তোমা’ যাচে,  

 কত জল-দেবীদের শুষ্ক মালা প’ড়ে তব চরণের কাছে,  

 চেয়ে নাহি দেখ, উদাসীন!  

 কার যেন স্বপ্নে তুমি মত্ত নিশিদিন!   

  

 মন্থর-মন্দার দিয়া দস্যু সুরাসুর  

 মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্ন-পুর,  

 হরিয়াছে উচ্চেঃশ্রবা, তব লক্ষ্মী, তব শশী-প্রিয়া  

 তার সব আছে আজ সুখে স্বর্গে গিয়া!  

 ক’রেছে লুন্ঠন  

 তোমার অমৃত-সুধা-তোমার জীবন!  

 সব গেছে, আছে শুধু ক্রন্দন-কল্লোল,  

 আছে জ্বালা, আছে স্মৃতি, ব্যথা-উতরোল  

 উর্ধ্বে শূন্য, নিম্নে শূন্য,-শূন্য চারিধার,  

 মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার!   

  

 হে মহান! হে চির-বিরহী!  

 হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে মোর বিদ্রোহী,  

 সুন্দর আমার!  

 নমস্কার!  

 নমস্কার লহ!  

 তুমি কাঁদ,-আমি কাঁদি,-কাঁদে মোর প্রিয়া অহরহ।  

 হে দুস্তর, আছে তব পার, আছে কূল,  

 এ অনন্ত বিরহের নাহি পার–নাহি কূল–শুধু স্বপ্ন, ভুল।  

 মাগিব বিদায় যবে, নাহি র’ব আর,  

 তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার!  

 বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয়  

 উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া!  

 তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার,  

 মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার। 

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাড়ি কবিতা - জসীম উদ্দীন | কবিতার জগৎ