সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ - কাজী নজরুল ইসলাম | কবিতার জগৎ

 হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর  

 হে মোর বিদ্রোহী!  

 রহি’ রহি’  

 কোন্‌ বেদনায়  

 তরঙ্গ-বিভঙ্গে মাতো উদ্দাম লীলায়!  

 হে উন্মত্ত, কেন এ নর্তন?  

 নিষ্ফল আক্রোশে কেন কর আস্ফালন  

 বেলাভূমে পড়ো আছাড়িয়া!  

 সর্বগ্রাসী! গ্রাসিতেছ মৃত্যু-ক্ষুধা নিয়া  

 ধরণীরে তিলে-তিলে!  

 হে অস্থির! স্থির নাহি হ’তে দিলে  

 পৃথিবীরে! ওগো নৃত্য-ভোলা,  

 ধরারে দোলায় শূন্যে তোমার হিন্দোলা!  

 হে চঞ্চল,  

 বারে বারে টানিতেছ দিগন্তিকা-বন্ধুর অঞ্চল!  

 কৌতুকী গো! তোমার এ-কৌতুকের অন্ত যেন নাই।-  

 কী যেন বৃথাই  

 খুঁজিতেছ কূলে কূলে  

 কার যেন পদরেখা!-কে নিশীথে এসেছিল ভুলে  

 তব তীরে, গর্বিতা সে নারী,  

 যত বারি আছে চোখে তব  

 সব দিলে পদে তার ঢালি’,  

 সে শুধু হাসিল উপক্ষায়!  

 তুমি গেলে করিতে চুম্বন, সে ফিরালো কঙ্কণের ঘায়!  

 –গেল চ’লে নারী!  

 সন্ধান করিয়া ফের, হে সন্ধানী, তারি  

 দিকে দিকে তরণীর দুরাশা লইয়া,  

 গর্জনে গর্জনে কাঁদ–“পিয়া, মোর পিয়া!’’   

  

 বলো বন্ধু, বুকে তব কেন এত বেগ, এত জ্বালা?  

 কে দিল না প্রতিদিন? কে ছিঁড়িল মালা?  

 কে সে গরবিনী বালা? কার এত রূপ এত প্রাণ,  

 হে সাগর, করিল তোমার অপমান!  

 হে মজনু, কোন্‌ সে লায়লীর  

 প্রণয়ে উন্মাদ তুমি?-বিরহ-অথির  

 করিয়াছে বিদ্রোহ ঘোষণা, সিন্ধুরাজ,  

 কোন্‌ রাজকুমারীর লাগি’? কারে আজ  

 পরাজিত করি’ রণে, তব প্রিয়া রাজ-দুহিতারে  

 আনিবে হরণ করি?-সারে সারে  

 দলে দলে চলে তব তরঙ্গের সেনা,  

 উষ্ণীষ তাদের শিরে শোভে শুভ্র ফেনা!  

 ঝটিকা তোমার সেনাপতি  

 আদেশ হানিয়া চলে উর্ধ্বে অগ্রগতি।  

 উড়ে চলে মেঘের বেলুন,  

 ‘মাইন্’ তোমার চোরা পর্বত নিপুণ!  

 হাঙ্গর কুম্ভীর তিমি চলে ‘সাবমেরিন’,  

 নৌ-সেনা চলিছে নীচে মীন!  

 সিন্ধু-ঘোটকেতে চড়ি’ চলিয়াছ বীর  

 উদ্দাম অস্থির!  

 কখন আনিবে জয় করি’-কবে সে আসিবে তব প্রিয়া,  

 সেই আশা নিয়া  

 মুক্তা-বুকে মালা রচি’ নীচে!  

 তোমার হেরেম্‌-বাঁদী শত শুক্তি-বধূ অপেক্ষিছে।  

 প্রবাল গাঁথিছে রক্ত-হার-  

 হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর-তোমার প্রিয়ার!  

 বধূ তব দীপাম্বীতা আসিবে কখন?  

 রচিতেছে নব নব দ্বীপ তারি প্রমোদ-কানন।  

 বক্ষে তব চলে সিন্ধু-পোত  

 ওরা তব যেন পোষা কপোতী-কপোত।  

 নাচায়ে আদর করে পাখীরে তোমার  

 ঢেউ-এর দোলায়, ওগো কোমল দুর্বার!  

 উচ্ছ্বাসে তোমার জল উলসিয়া উঠে,  

 ও বুঝি চুম্বর তব তা’র চঞ্চুপুটে?  

 আশা তব ওড়ে লুব্ধ সাগর-শকুন,  

 তটভূমি টেনে চলে তব আশা-তারকার গুণ!  

 উড়ে যায় নাম-নাহি-জানা কত পাখী,  

 ও যেন স্বপন তব!-কী তুমি একাকী  

 ভাব কভু আনমনে যেন,  

 সহসা লুকাতে চাও আপনারে কেন!  

 ফিরে চলো ভাঁটি-টানে কোন্‌ অন্তরালে,  

 যেন তুমি বেঁচে যাও নিজেরে লুকালে!-  

 শ্রান্ত মাঝি গাহে গান ভাটিয়ালী সুরে,  

 ভেসে যেতে চায় প্রাণ দূরে-আরো দূরে।  

 সীমাহীন নিরুদ্দেশ পথে,  

 মাঝি ভাসে, তুমি ভাস, আমি ভাসি স্রোতে।   

  

 নিরুদ্দেশ! শুনে কোন্‌ আড়ালীর ডাক  

 ভাটিয়ালী পথে চলো একাকী নির্বাক?  

 অন্তরের তলা হ’তে শোন কি আহবান?  

 কোন্‌ অন্তরিকা কাঁদে অন্তরালে থাকি’ যেন,  

 চাহে তব প্রাণ!  

 বাহিরে না পেয়ে তারে ফের তুমি অন্তরের পানে  

 লজ্জায়-ব্যথায়-অপমানে!  

 তারপর, বিরাট পুরুষ! বোঝা নিজ ভুল  

 জোয়ারে উচ্ছ্বসি’ ওঠো, ভেঙে চল কূল  

 দিকে দিকে প্লাবনের বাজায়ে বিষাণ  

 বলো, ‘ প্রেম করে না দুর্বল ওরে করে মহীয়ান্!’  

 বারণী সাকীরে কহ, ‘ আনো সখি সুরার পেয়ালা!’  

 আনন্দে নাচিয়া ওঠো দুখের নেশায় বীর, ভোল সব জ্বালা!  

 অন্তরের নিষ্পেষিত ব্যথার ক্রন্দন  

 ফেনা হ’য়ে ওঠে মুখে বিষর মতন।  

 হে শিব, পাগল!  

 তব কন্ঠে ধরি’ রাখো সেই জ্বালা-সেই হলাহল!  

 হে বন্ধু, হে সখা,  

 এতদিনে দেখা হ’ল, মোরা দুই বন্ধু পলাতকা।   

  

 কত কথা আছে-কত গান আছে শোনাবার,  

 কত ব্যথা জানাবার আছে-সিন্ধু, বন্ধু গো আমার!  

 এসো বন্ধু, মুখোমুখি বসি,  

 অথবা টানিয়া লহ তরঙ্গের আলিঙ্গন দিয়া, দুঁহু পশি  

 ঢেউ নাই যেথা-শুধু নিতল সুনীল!-  

 তিমির কহিয়া দাও-সে যেন খোলে না খিল  

 থাকে দ্বারে বসি’,  

 সেইখানে ক’ব কথা। যেন রবি-শশী  

 নাহি পশে সেথা।  

 তুমি র’বে-আমি র’ব-আর র’বে ব্যথা!  

 সেথা শুধু ডুবে র’বে কথা নাহি কহি’,-  

 যদি কই,-  

 নাই সেথা দু’টি কথা বই,  

 আমিও বিরহী, বন্ধু, তুমিও বিরহী!’ 

Comments

Popular posts from this blog

আমার বাড়ি কবিতা - জসীম উদ্দীন | কবিতার জগৎ