Posts

চির আমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,    বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,    চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা    বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -    আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,    তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।       যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,    কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,    ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,    শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -    আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,    তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।       যখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,    কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।    ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সেদিন উঠবে ভরি,    চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।    আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,    তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।       তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?    সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি। ...

চিত্ত তোমায় নিত্য হবে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে    সত্য হবে -    ওগো সত্য, আমার এখন সুদিন।    ঘটবে কবে।    সত্য সত্য সত্য জপি,    সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি,    সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব    নিখিল ভবে -    সত্য তোমার পূর্ণ প্রকাশ    দেখব কবে।       তোমায় দূরে সরিয়ে মরি    আপন অসত্যে।    কী যে কান্ড করি গো সেই    ভূতের রাজত্বে।    আমার আমি ধুয়ে মুছে    তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে,    সত্য, তোমায় সত্য হব    বাঁচব তবে -    তোমার মধ্যে মরণ আমার মরবে কবে। 

চড়িভাতি কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 ফল ধরেছে বটের ডালে ডালে;    অফুরন্ত আতিথ্যে তার সকালে বৈকালে    বনভোজনে পাখিরা সব আসছে ঝাঁকে ঝাঁক।    মাঠের ধারে আমার ছিল চড়িভাতির ডাক।    যে যার আপন ভাঁড়ার থেকে যা পেল যেইখানে    মালমসলা নানারকম জুটিয়ে সবাই আনে।    জাত-বেজাতের চালে ডালে মিশোল ক'রে শেষে    ডুমুরগাছের তলাটাতে মিলল সবাই এসে।    বারে বারে ঘটি ভ'রে জল তুলে কেউ আনে,    কেউ চলেছে কাঠের খোঁজে আমবাগানের পানে।    হাঁসের ডিমের সন্ধানে কেউ গেল গাঁয়ের মাঝে,    তিন কন্যা লেগে গেল রান্নাকরার কাজে।    গাঁঠ-পাকানো শিকড়েতে মাথাটা তার থুয়ে    কেউ পড়ে যায় গল্পের বই জামের তলায় শুয়ে।    সকল-কর্ম-ভোলা    দিনটা যেন ছুটির নৌকা বাঁধন-রশি-খোলা    চলে যাচ্ছে আপনি ভেসে সে কোন্ আঘাটায়    যথেচ্ছ ভাঁটায়।    মানুষ যখন পাকা ক'রে প্রাচীর তোলে নাই    মাঠে বনে শৈলগুহায় যখন তাহার ঠাঁই,    সেইদিনকার আল্গা-বিধির বাইরে-ঘোরা প্রাণ    ম...

গানের পারে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ও পারে।    আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।    বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী,    এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়-মাঝারে।।    তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে -    বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে।    কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি    আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে?

কত অজানারে জানাইলে তুমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 কত অজানারে জানাইলে তুমি,    কত ঘরে দিলে ঠাঁই-    দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,    পরকে করিলে ভাই।    পুরনো আবাস ছেড়ে যাই যবে    মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে,    নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন    সে কথা যে ভুলে যাই।    দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,    পরকে করিলে ভাই।       জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে    যখনি যেখানে লবে,    চির জনমের পরিচিত ওহে,    তুমিই চিনাবে সবে।    তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর,    নাহি কোন মানা, নাহি কোন ডর,    সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ-    দেখা যেন সদা পাই।    দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,    পরকে করিলে ভাই।

ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 ওরে  নবীন, ওরে আমার কাঁচা,    ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,    আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।    রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে    আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,    সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে    পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।    আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।       খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়;    আর তো কিছুই নড়ে না রে    ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়।    ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,    চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,    ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা    অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।    আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।       বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,    দেখে না যে বাণ ডেকেছে    জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।    চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে    মাটির ‘পরে চরণ ফেলে ফেলে,    আছে অচল আসনখানা মেলে    যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়,    আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।   ...

আষাঢ় কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।    ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।    বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,    আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,    কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে।    ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।       ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে।    এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।    দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি    মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,    রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।    এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।       শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।    খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।    পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,    দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ,    দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে।    খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।       ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।    আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর...

আরশি কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 তোমার যে ছায়া তুমি দিলে আরশিরে    হাসিমুখ মেজে,    সেইক্ষণে অবিকল সেই ছায়াটিরে    ফিরে দিল সে যে।    রাখিল না কিছু আর,    স্ফটিক সে নির্বিকার    আকাশের মতো--    সেথা আসে শশী রবি,    যায় চলে, তার ছবি    কোথা হয় গত।       একদিন শুধু মোরে ছায়া দিয়ে, শেষে    সমাপিলে খেলা    আত্মভোলা বসন্তের উন্মত্ত নিমেষে    শুক্ল সন্ধ্যাবেলা।    সে ছায়া খেলারই ছলে    নিয়েছিনু হিয়াতলে    হেলাভরে হেসে,    ভেবেছিনু চুপে চুপে    ফিরে দিব ছায়ারূপে    তোমারি উদ্দেশে।       সে ছায়া তো ফিরিল না, সে আমার প্রাণে    হল প্রাণবান।    দেখি, ধরা পড়ে গেল কবে মোর গানে    তোমার সে দান।    যদিবা দেখিতে তারে    পারিতে না চিনিবারে    অয়ি এলোকেশী--    আমার পরান পেয়ে    সে আজি তোমারো চেয়ে    বহুগুণে বেশি...

আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,    বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।    এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর    জীবন ভ'রে।    না চাহিতে মোরে যা করেছ দান    আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,    দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়    সে মহাদানেরই যোগ্য করে    অতি-ইচ্ছার সংকট হতে    বাঁচায়ে মোরে।    আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি    তোমার পথের লক্ষ্য ধরে-    তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে    যাও যে সরে।    এ যে তব দয়া জানি হায়,    নিতে চাও ব'লে ফিরাও আমায়,    পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন    তব মিলনেরই যোগ্য করে    আধা- ইচ্ছার সংকট হতে    বাঁচায়ে মোরে। 

আমি চেয়ে আছি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | kobitar jagot

 আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবা-পানে।    স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।    নীচে সব-নীচে এ ধূলির ধরণীতে    যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে,    যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নাই কিছু,    যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে।    স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।       যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়,    যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়।    আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে    এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে,    সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম    ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে।    স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে। 

আমার মিলন লাগি তুমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 আমার মিলন লাগি তুমি    আসছ কবে থেকে।    তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়    রাখবে কোথায় ঢেকে।    কত কালের সকাল-সাঁঝে    তোমার চরণধ্বনি বাজে,    গোপনে দূত গৃহ-মাঝে    গেছে আমায় ডেকে।       ওগো পথিক, আজকে আমার    সকল পরাণ ব্যেপে    থেকে থেকে হরষ যেন    উঠছে কেঁপে কেঁপে    যেন সময় এসেছে আজ,    ফুরালো মোর যা ছিল কাজ -    বাতাস আসে, হে মহারাজ,    তোমার গন্ধ মেখে। 

আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিতার জগৎ

 আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে    তখন কে তুমি তা কে জানত।    তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,    জীবন বহে যেত অশান্ত।    তুমি ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত    যেন আমার আপন সখার মতো,    হেসে তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে    সেদিন কত-না বন-বনান্ত।       ওগো, সেদিন তুমি গাইতে যে সব গান    কোনো অর্থ তাহার কে জানত।    শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,    সদা নাচত হৃদয় অশান্ত।    হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি -    স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,    তোমার চরণপানে নয়ন করি নত    ভুবন দাঁড়িয়ে গেছে একান্ত।